সৈয়দ এ. এফ. এম. মঞ্জুর-এ-খোদা
(গত সপ্তাহের পর)
৯ম সংস্কার
উদ্যোগ গ্রহণকারী: ৩৯তম আব্বাসিয় খলিফা আল-মুসতাসিম বিল্লাহ
সময়: ১২৫৬-১২৬৯ খ্রিষ্টাব্দ (৬৫৪-৬৬৭ হিজরি)
বিবরণ:১২৫৬ খ্রিষ্টাব্দে (৬৫৪ হিজরি) অগ্নিকাণ্ডের ফলে মসজিদে নববি-এর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তখন ৩৯তম এবং সর্বশেষ আব্বাসিয় খলিফা আল-মুসতাসিম বিল্লাহ (শাসনকাল: ১২৪২-১২৫৮ খ্রি.) মসজিদে নববি-এর সংস্কারের জন্য বাগদাদ থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও শ্রমিক পাঠান। তবে হালাকু খানকর্তৃক বাগদাদ দখলের কারণে ঐ বছরই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে তার এই সংস্কার কাজ ৪র্থ মামলুক সুলতানআল মালিক আল জহির রুকন আল দিন বাইবার্স (শাসনকাল: ১২৬০-১২৭৭ খ্রি./ ৬৫৮-৬৭৫ হি.) সমাপ্ত করেন। এই সময় মসজিদে নববি-এর আয়তন বাড়ানো হয়নি। তবে হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারকের কিছু সংস্কার কাজ করা হয়। এসময় হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারকের চারপাশে একটি বেষ্টনী তৈরি করা হয়।
১০ম সংস্কার
উদ্যোগ গ্রহণকারী: ৭ম মামলুক সুলতান আল-মনসুর কালাওয়ান
সময়: ১২৭৯ খ্রিষ্টাব্দ (৬৭৭ হিজরি)
বিবরণ: ৭ম মামলুক সুলতান আল-মনসুর কালাওয়ান (শাসনকাল: ১২৭৯-১২৯০ খ্রি.) ১২৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথমহযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারকের উপরের গম্বুজটি তৈরি করেন। ইতঃপূর্বে আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারকের উপরে কোনো গম্বুজ ছিল না। গম্বুজটি কাঠ দ্বারা তৈরি করা হয়।প্রথমে গম্বুজটির কোনো রং ছিল না। পরবর্তীতেএকে প্রথমে সাদা এবং পরে নীল রং করা হয়। তিনি মসজিদে নববি-এর পশ্চিম দেওয়ালে অবস্থিত প্রবেশদ্বার বাবে সালাম-এর বাইরে নামাজিদের ওজুকরার জন্য একটি ঝরনা নির্মাণ করেন।
১১তম সংস্কার
উদ্যোগ গ্রহণকারী: ১৪তম মামলুক সুলতান আন-নাসির মুহাম্মদ
সময়: ১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দ (৭২৯ হিজরি)
বিবরণ:১৪তম মামলুক সুলতান, আন-নাসির মুহাম্মদ (শাসনকাল: ১৩১০-১৩৪১ খ্রি.) ১২৫৬ খ্রিষ্টাব্দে (৬৫৪ হিজরি) সংঘটিত ১ম অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদে নববি-এর মিনারটি পুনরায় নির্মাণ করেন এবং মসজিদের পূর্ব ও পশ্চিম ছাদের ২টি গম্বুজ বর্ধিত করেন।
মসজিদে নববিতে ২য় অগ্নিকাণ্ড [১৪৮১ খ্রিষ্টাব্দ (৮৮৬ হিজরি)]
১৪৮১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর (১৩ রমজান, ৮৮৬ হিজরি) রাতে মসজিদে নববি-তে ২য় বারের মতো এক ভয়ানক অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। সেই রাতে আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন এবং ঘন ঘন বজ্রপাত হচ্ছিল। এশার সময় মসজিদে নববি-এর তৎকালীন মুয়াজ্জিন শামসুদ্দিন বিন খতিব আজান দেওয়ার জন্যমসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব মিনারে ওঠেন। ঠিক সেসময় ঐ মিনারে এক ভয়ংকর বজ্র আঘাত হানে। প্রচণ্ড বজ্রপাতে সাথে সাথে মিনারটি ধ্বংস হয়ে আগুনের সূত্রপাত হয়এবং মুয়াজ্জিন তৎক্ষণাৎ ইন্তেকাল করেন। মুহূর্তের মধ্যে সমগ্র মসজিদে নববি-তে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি আশপাশের বাড়িঘর সমূহেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। মদিনার অধিবাসীগণ দ্রুত মসজিদে নববি-তে ছুটে আসেন এবং আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। এই অগ্নিকাণ্ডে বেশ কয়েকজন মৃত্যুবরণ করে।
১২তম সংস্কার
উদ্যোগ গ্রহণকারী: ৪৭তম মামলুক সুলতান সাইফুদ্দিন আল-আশরাফ কাইতবে
সময়: ১৪৮১-১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দ (৮৮৬-৮৯০ হিজরি)
বিবরণ:১৪৮১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর (১৩ রমজান, ৮৮৬ হিজরি) রাতে ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ডে মসজিদে নববি-এর ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। এই ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ডের পরমদিনাবাসীরামসজিদে নববি-এর সংস্কারের আবেদন জানিয়ে৪৭তম মামলুক সুলতান সাইফুদ্দিন আল-আশরাফ কাইতবে (শাসনকাল: ১৪৬৮-১৪৯৬ খ্রি.)-এর নিকট চিঠি প্রেরণ করেন। এসময় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মসজিদে নববি-কে নতুনভাবে নির্মাণের জন্য, সুলতান আশরাফ কাইতবে বহু শ্রমিক ও যন্ত্রপাতি-সহ তার কর্মচারী আমির সানকার আল জাবলি-কে মদিনায় প্রেরণ করেন। তিনি মসজিদের ২টি ছাদকে একত্রিত করে ১টি ছাদে রূপান্তর করেন। ছাদটি কাঠ ও ইট দ্বারা তৈরি করা হয় এবং ছাদের উচ্চতা হয় ৩৩ ফুট।মসজিদ ভবনের স্তম্ভগুলো কালো পাথর ও লোহা দিয়ে নির্মাণ করা হয়। ১৪৮৩ খ্রিষ্টাব্দে (৮৮৮ হিজরি) ছাদের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। অগ্নিকাণ্ডের কারণে হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারকের উপরে নির্মিত কাঠের গম্বুজটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তিনি এই গম্বুজটি কংক্রিট ও সীসার পাত দ্বারা পুনঃনির্মাণ করেন।তিনি হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারকের দেওয়াল মার্বেল পাথর দ্বারা সুসজ্জিত করেন এবং কাঠের বেষ্টনীর পরিবর্তে পিতলের বেষ্টনী নির্মাণ করেন। বর্তমানে যে মেহরাব-এ দাঁড়িয়ে ইমাম নামাজ আদায় করেন, সেই মেহরাবটি তিনিই নির্মাণ করেন। তিনি মসজিদের পূর্ব দিকে প্রায় ১,২৯২ বর্গফুট আয়তন বৃদ্ধি করেন। ফলে সংস্কারের পর মসজিদের আয়তন দাঁড়ায় ১,২৩,৫৪০ বর্গফুট। এই নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দে (৮৯০ হিজরি)। এই সংস্কারকার্যে সুলতান কাইতবে ৬০,০০০ মিশরিয় গিনি খরচ করেন।
১৩তম সংস্কার
উদ্যোগ গ্রহণকারী:১০ম উসমানিয় সুলতান ১ম সুলেমান
সময়কাল: ১৫২০-১৫৬৬ খ্রিষ্টাব্দ (৯২৬-৯৭৩ হিজরি)
বিবরণ:১০ম উসমানিয় (ঙঃঃড়সধহ) সুলতান প্রথম সুলেমান(শাসনকাল: ১৫২০-১৫৬৬ খ্রি./৯২৬-৯৭৩ হি.) মসজিদে নববি-এর উত্তর-পূর্ব দিকে ‘সুলাইমানিয়া মিনার’ তৈরি করেছিলেন। তিনি মসজিদের পশ্চিম দেওয়ালে অবস্থিত ‘বাবে রহমত’-নামক প্রবেশদ্বার থেকে সুলাইমানিয়া মিনার পর্যন্ত পুনর্নির্মাণ করেন। তিনি এসময় বাবে রহমত প্রবেশদ্বারকেও সৌন্দর্যমণ্ডিত করেন এবং হযরত রাসুল (সা.)-এর ব্যবহৃত মিম্বর শাফিয়া-এর নিকটে ‘আনাফ’ নামে নতুন একটি মিম্বর স্থাপন করেন।
১৪তম সংস্কার
উদ্যোগ গ্রহণকারী: ১১তম উসমানিয় সুলতান ২য় সেলিম
সময়: ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দ (৯৮০ হিজরি)
বিবরণ:১১তম উসমানিয়য় সুলতান ২য় সেলিম (শাসনকাল: ১৫৬৬-১৫৭৪ খ্রি.) ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দে হযরত রাসুল (সা.)-এর মিম্বর থেকে পশ্চিম দিকে এবং মূল মসজিদ থেকে পৃথকভাবে একটি মেহরাব নির্মাণ করেন।
১৫তম সংস্কার
উদ্যোগ গ্রহণকারী: ১২তম উসমানিয় সুলতান তৃতীয় মুরাদ
সময়: ১৫৭৪-১৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দ (৯৮১-১০০৩ হিজরি)
বর্তমানে যে মিম্বরটি ব্যবহৃত হয় তা ১২তম উসমানিয় সুলতান তৃতীয় মুরাদ (শাসনকাল: ১৫৭৪-১৫৯৫ খ্রি./৯৮১-১০০৩ হি.) নির্মাণ করেন।
সৌদি বাদশাহ কর্তৃক হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারকের অলঙ্কার হরণ
সৌদি আরবের বাদশাহ সৌদ বিন আবদুল আজিজ বিন মুহাম্মদ (শাসনকাল: ১৮০৩-১৮১৪ খ্রি.) ওহাবিমতাবলম্বী ছিল। ১৮০৫ সালে তার নির্দেশে মদিনায় অবস্থিত আহলে বাইত ও সাহাবায়ে কেরামেররওজা শরীফের অবকাঠামো (ওহভৎধংঃৎঁপঃঁৎব) ভেঙে ফেলে। শুধু হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারকের উপর নির্মিত গম্বুজ তাদের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছিল। তবে এসময় তারা হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারকে খচিত স্বর্ণ ও রত্নালংকার লুটে নেয়।
১৬তম সংস্কার
উদ্যোগ গ্রহণকারী: ৩০ তম উসমানিয়য় সুলতান ২য় মাহমুদ
সময়: ১৮১৭-১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দ (১২৩৩-১২৫২ হিজরি)
বিবরণ:১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে (১২৩৩ হিজরি) ৩০তম উসামনিয় সুলতান ২য় মাহমুদ (শাসনকাল: ১৮০৮-১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দ) মসজিদে নববি-এর দক্ষিণ-পূর্ব পাশে অবস্থিত হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারকের উপরের গম্বুজটি পুনর্নির্মাণ করেন। তিনি ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে (১২৫২ হিজরি) গম্বুজটিতে সর্বপ্রথম সবুজ রং করেন। পরবর্তীতে এই গম্বুজের রং আর পরিবর্তন করা হয়নি। এই গম্বুজটি ‘কুব্বেই হাদরা’ নামে অধিক পরিচিত। আরবি ‘কুব্বেই হাদরা’ শব্দের বাংলা অর্থ সবুজ গম্বুজ(ঞযব এৎববহ উড়সব)
১৭তম সংস্কার
উদ্যোগ গ্রহণকারী: ৩১তম উসমানিয়য় সুলতান ১ম আবদুল মজিদ
সময়: ১৮৪৯-১৮৬২খ্রিষ্টাব্দ (১২৬৫-১২৭৮ হিজরি)
বিবরণ: ১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ৪৭তম মামলুক সুলতান সাইফুদ্দিনকাইতবে মসজিদে নববি-এর ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। এরপর ১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৩৬৪ বছর কোনো মুসলিম শাসক সুলতান সাইফুদ্দিন কাইতবে-এর নির্মিত অবকাঠামোর সংস্কার করেননি। দীর্ঘকাল সংস্কারনা করার কারণে মসজিদের কিছু কিছু জায়গায় ফাটল দেখা দেয়, দেওয়াল ও ছাদ নষ্ট হয়ে যায়। এমতাবস্থায় ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে (১২৬৩ হিজরি) তৎকালীন মসজিদে নববি-এর ইমাম দাউদ পাশা মসজিদে নববি সংস্কারের অনুরোধ জানিয়ে৩১তম উসমানিয়য় সুলতান ১মআবদুল মজিদ (শাসনকাল: ১৮৩৯-১৮৬১ খ্রি.)-কে চিঠি পাঠান।এই চিঠি পাওয়ার পর সুলতান ১ম আবদুল মজিদ তৎক্ষণাৎ মসজিদে নববিপর্যবেক্ষণ এবং পরিদর্শনের জন্য প্রকৌশলী-সহ তার বিশ্বস্ত একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন। এই প্রতিনিধিদল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুলতানকে জানালেন যে, মসজিদটিকে নতুনভাবে নির্মাণ করা অতীব জরুরি। অতঃপর ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে (১২৬৫ হিজরি) সুলতান ১ম আবদুল মজিদ প্রয়োজনীয় উপকরণ-সহ তার অধীনস্থ হালিম এফেন্দি-কে মদিনায় প্রেরণ করেন। শ্রমিকরা নির্মাণ কাজের জন্য পাহাড় থেকে আকিক পাথরের ন্যায় লাল রঙের বড়ো বড়ো পাথরের টুকরা কেটে আনেন। এক পাশের নির্মাণ কাজ শেষ করে অন্য পাশের নির্মাণ কাজ শুরু করা হতো, যেন নামাজিদের কোনো অসুবিধা না হয়।সুলতান ১ম আবদুল মজিদ মসজিদে নববি-কে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করেন। তিনি মসজিদের আয়তন ১৩,৯২০ বর্গফুট বৃদ্ধি করেন। ফলে মসজিদের মোট আয়তন হয় ১,৩৭,৪৬০ বর্গফুট।এই সময় পূর্বের স্তম্ভগুলিকে ফেলে দিয়ে নতুন স্তম্ভ তৈরি করা হয়।তিনি ছাদের বিভিন্ন অংশকে একত্রিত করেন এবং স্তম্ভগুলি সীসাদ্বারা ও দরজাগুলি স্বর্ণ দ্বারা সৌন্দর্যমন্ডিত করেছিলেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারকের স্তম্ভগুলি সাদা ও লাল রংয়ের দুর্লভ মার্বেল পাথর দ্বারাসুসজ্জিত করা হয় যেন স্তম্ভগুলো আলাদা ও বিশেষ মনে হয়। পূর্বে মসজিদের বারান্দায় ৪টি প্রবেশদ্বার ছিল।‘বাবে মজিদি’ নামে নতুন আরও ১টি প্রবেশদ্বার নির্মাণ করা হয়।বর্তমানে এই প্রবেশদ্বারটি মসজিদের ভিতরে অবস্থিত। তবে সুলতান সাইফুদ্দিন কাইতবে-এর সময়ে নির্মিত হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা শরীফ, পশ্চিম দিকের দেওয়াল, মেহরাবে নববি, মেহরাবে সুলাইমানি, মেহরাবে উসমানিয়, মিম্বর এবং সুলাইমানিয়া মিনারমজবুত ও সৌন্দর্যপূর্ণ ছিল বিধায় সুলতান ১ম আবদুল মজিদ এই স্থাপনাগুলোর সংস্কার করেননি। দক্ষিণে নামাজ আদায়ের স্থানটি প্রস্থে দ্বিগুণ করা হয় এবং হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারক, মিহরাব অঞ্চল, বাবে সালাম ব্যতীত নামাজ আদায়ের সম্পূর্ণ স্থানটি ছোটো ছোটো আকারের গম্বুজ দ্বারা আবৃত করা হয়।ছাদের সকল গম্বুজে নকশা ও কারুকার্য করা হয়।মসজিদের সামনের দেওয়ালে সোনালি অক্ষরে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন সূরা, হযরত রাসুল (সা.)-এর নাম ইত্যাদি নকশা অঙ্কন করা হয়।
তিনি মসজিদের বিছানার উপর এবং কেবলার দিকের দেওয়ালের অর্ধেক পর্যন্ত মার্বেল পাথর স্থাপন করেন। মসজিদে নববি-এর মেঝে সমান না থাকায় তা ভেঙে সমান করেন। সীমানার ভিত্তি পূর্বের মতো গভীর করে খনন করে কালো পাথর দিয়ে তৈরি করেন। ৫ম উমাইয়া খলিফা ১ম ওয়ালিদ-এর আমলে মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে, উত্তর-পূর্ব কোণে, পূর্ব-দক্ষিণ কোণে এবং পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে ৪টি মিনার ছিল। সুলতান ১ম আবদুল মজিদ এই ৪টি মিনার পুনর্নির্মাণ করেন। সেই সাথে তিনি পশ্চিমে ‘বাবুর রাহমাহ’ নামে নতুন আরও ১টি মিনার তৈরি করেন। এসময় মসজিদ নববি-কে এমন সুন্দর কারুকার্যে খচিত করা হয়েছিল, যা ইতঃপূর্বে হয়নি। বর্তমান মসজিদে নববিতেও ঐ আমলের কিছু অংশ ঠিক সেইভাবেই রাখা হয়েছে, যা মজবুত ও কারুকার্যমণ্ডিত হওয়ার কারণে সংস্কারের প্রয়োজন পড়েনি। এই সংস্কারকার্যে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার উসমানিয়য় মুদ্রা ব্যয় হয়। সুলতান আবদুল মজিদ মসজিদে নববি-এর কাজ সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন।তিনি ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে (১২৬৫ হিজরি) মসজিদে নববি-এর পুনর্নির্মাণ শুরু করেন এবং প্রায় ১৩ বছর কাজ করার পর ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে (১২৭৮ হিজরি) নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়।

১৮তম সংস্কার (১ম সৌদি সম্প্রসারণ)
উদ্যোগ গ্রহণকারী: বাদশাহ আবদুল আজিজ আল সৌদ এবং বাদশাহ সৌদ বিন আবদুল আজিজ
সময়: ১৯৪৯-১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দ (১৩৬৮-১৩৭৫ হিজরি)
বিবরণ: ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দের পরে মসজিদে নববি-এর আর কোনো সংস্কার বা সম্প্রসারণ করা হয়নি। যার ফলে মসজিদের কাঠামোতে ফাটল সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে উত্তর অংশে। তাছাড়া ক্রমবর্ধমান মুসল্লিদের আগমন এবংহজের মৌসুমে মুসল্লিদের সংখ্যা আরো বহুগুণে বেড়ে যাওয়ার কারনে মসজিদে নববি-তে মুসল্লিদের স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। ফলশ্রুতিতে মসজিদে নববি-এর সংস্কার ও সম্প্রসারণ করার প্রয়োজন দেখা দেয়।
তখন ১ম সৌদি বাদশাহ আব্দুল আজিজ (শাসনকাল: ১৯৩২-১৯৫৩ খ্রি.) ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে (১৩৬৮ হি.) মসজিদে নববি-এর সংস্কার ও সম্প্রসারণের জন্য কমিশন গঠন করেন। প্রাথমিক নির্মাণ প্রস্তুতি ওজমি অধিগ্রহণে ২ বছর অতিবাহিত হয়েছিল। কমিশন গঠনের ২ বছর পর ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ অক্টোবর (১৩৭০ হি.) বাদশাহ আব্দুল আজিজের পুত্র বাদশাহ সৌদ বিন আবদুল আজিজ নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেসময় বাদশাহ আবদুল আজিজ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন। এই কারণে তার পুত্র সৌদ বিন আবদুল আজিজ নির্মাণ কাজের তদারকি করতেন। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৯ নভেম্বর বাদশাহ আবদুল আজিজ মৃত্যুবরণ করার পর তার পুত্র সৌদ বিন আবদুল আজিজ বাদশাহ হন। এরপর বাদশাহ সৌদ বিন আবদুল আজিজ(শাসনকাল: ১৯৫৩-১৯৬৪ খ্রি.)-এর সার্বিক তত্ত্বাবধানেই মসজিদে নববি-এর সংস্কার এবং সম্প্রসারণ হয়েছিল। এই প্রকল্পের স্থপতি ছিলেন মিশরের বিখ্যাত স্থপতি মোস্তফা আল ফাহমি।
সেসময় মদিনার বাইরে ‘আবায়ার আলী’ নামক স্থানে একটি মোজাইক কারখানা স্থাপন করা হয়। উল্লেখ্য যে, মদিনা পবিত্র নগরী হওয়ায় অমুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তাই একদল ইতালীয় অমুসলিমপ্রকৌশলী মদিনায় প্রবেশ না করে সেখানে অবস্থান করে পুনর্র্নির্মাণ কাজের নেতৃত্ব দেন। মার্বেল পাথর এবং অন্যান্য নির্মাণ উপকরণ মদিনার বাহিরে অবস্থিত কারখানা থেকে মসজিদে পাঠানো হতো। এছাড়াও ‘ইয়ানবু বন্দর’ থেকে যানবাহনে করে প্রায় ৩০,০০০ মেট্রিক টন পরিমাণ নির্মাণ সামগ্রী মদিনায় পরিবহন করা হয়েছিল ।
এসময় মূলত মসজিদে নববি-এর উত্তর অংশ সম্প্রসারিত করা হয়েছিল। তাছাড়াও পূর্ব ও পশ্চিম অংশ সামান্য প্রসারিত করা হয়েছিল। এই সম্প্রসারণের পর মসজিদে নববি আয়তক্ষেত্রের আকার লাভ করে।
শক্তিশালী কংক্রিট দিয়ে তৈরি ২৭৪টি বর্গাকৃতির এবং ২৩২টি গোলাকৃতির স্তম্ভের উপর মসজিদে নববি-এর নতুন কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছিল। সমগ্র মসজিদ ভবনটি খোদাইকৃত পাথর দ্বারা অলংকৃত করা হয়। এই সংস্কারে নির্মিত উল্লেখযোগ্য কিছু স্থাপনানিচে উপস্থাপন করা হলো-
পূর্বের দুটি মিনার (সুলাইমানিয়া ও মাজেদিয়া মিনার) ভেঙে সেখানে মামলুক স্থাপত্য রীতিতে(গধসষঁশ অৎপযরঃবপঃঁৎব ঝঃুষব)দুটি নতুন মিনার নির্মাণ করা হয়এবং আরও দুটি নতুন মিনার মসজিদের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম দিকে স্থাপন করা হয়। এই ৪টি মিনারের প্রতিটির উচ্চতা ছিল ২৩৬ ফুট।
মসজিদের উত্তর দিকের বর্ধিত অংশে মার্বেল পাথর নির্মিত নতুন আরো একটিআঙিনা (ঈড়ঁৎঃুধৎফ) নির্মাণ করা হয়।
মসজিদের পূর্ব, পশ্চিম প্রান্তে এবং আঙিনার উভয়পাশে ছাউনি নির্মাণ করা হয়।
মসজিদের পশ্চিম প্রান্তে একটি লাইব্রেরি স্থাপন করা হয়। যেখানে পবিত্র কুরআনের ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপি ও অন্যান্য ধর্মীয়গ্রন্থাবলি সংরক্ষিত আছে।
নতুন ৫টি প্রবেশদ্বার নির্মাণ করা হয়। ফলে মসজিদে নববি-এর প্রবেশদ্বারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪১টিতে । নব নির্মিত ৫টি প্রবেশদ্বার হলো-
১. আবদুল আজিজ দরজা: মসজিদে নববি-এর পূর্ব দেওয়ালে বাব উন নিসা-এর পরে এটি অবস্থিত। বাব উন নিসা-এর পাশাপাশি তিনটি দরজার মধ্যে এই দরজাটি বৃহত্তম।
২. উসমান ইবন আফফান দরজা: মসজিদে নববি-এর উত্তর-পূর্ব কোণে এই দরজাটি অবস্থিত।
৩. মজিদি দরজা: উত্তর দেওয়ালের মধ্যবর্তী স্থানে এই দরজাটি অবস্থিত। ৩১তম উসমানীয় সুলতান ১ম আবদুল মজিদের নির্মাণের স্মৃতি স্বরূপ এর নামকরণ করা হয়।
৪. উমার ইবনে খাত্তাব দরজা: মসজিদে নববি-এর উত্তর-পশ্চিম কোণে এই দরজাটি অবস্থিত।
৫. সৌদ দরজা: পশ্চিম দেওয়ালের মধ্যভাগে এই দরজাটি অবস্থিত। বাবুর রাহমাহ-এর উত্তরে পাশাপাশি তিনটি দরজার মধ্যে এটি বৃহত্তম দরজা।
মসজিদের দক্ষিণ অংশে হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে স্মৃতিবিজড়িত উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহ এবং সুলতান আব্দুল মজিদ কর্তৃক নির্মিত স্থাপনাসমূহের কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। যার মধ্যে ছিল হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারক, মিহরাবে নববি, মিম্বর, ঐতিহাসিক স্তম্ভসমূহ, সবুজ গম্বুজ এবং প্রধান মিনার।
এই সংস্কারের পর মসজিদে নববি-এর নতুন ভবনের আয়তন দাঁড়ায় ১,২৫,৫৮০ বর্গফুট যা উত্তর-দক্ষিণে ৪২০ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ২৯৯ ফুট । মসজিদ ভবনের আশেপাশের বর্ধিত এলাকার মোট আয়তন ৬৪,৮৪২ বর্গফুট। ফলে মসজিদের সর্বমোট আয়তন দাঁড়ায় ১,৯০,২২০ বর্গফুট। এই সম্প্রসারণের ফলে মসজিদে নববি-তে একসাথে ২৮,০০০ লোক নামাজ আদায় করতে পারত। এই নির্মাণ কাজে ৭কোটি সৌদি রিয়াল খরচ হয়। ৩কোটি রিয়াল মসজিদ নির্মাণে এবং ৪কোটি রিয়াল জমি অধিগ্রহণে ব্যয়হয়। মসজিদে নববি-এর নির্মাণ কাজ প্রায় ৫ বছর পর ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে (১৩৭৫ হিজরির রবিউল আউয়াল) আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়। (চলবে)
সৈয়দ এ. এফ. এম. মঞ্জুর-এ-খোদা : সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ