
মহান স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহ্ তায়ালা সৃষ্টির সূচনার পূর্বে এক ও অদ্বিতীয় সত্তা অবস্থায় বিরাজমান ছিলেন। তখন তাঁর মাঝে স্বীয় পরিচয় প্রকাশের অভিলাষ জাগরিত হওয়ার পর সৃষ্টিজগৎ সৃজন করলেন। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ্ তায়ালা নিজেই এরশাদ করেন-
“আমিছিলাম গুপ্ত ধনাগার, নিজেকে প্রকাশ করতে ভালোবাসলাম, তাই সৃষ্টিজগৎ সৃজন করলাম।”
(সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা-১০)
আপন রূপ, গুণ ও মাধুর্য প্রকাশের লক্ষ্যে আল্লাহ্ তায়ালা সর্বপ্রথম তাঁর সমস্ত গুণাবলির ধারকরূপে ‘নূরে মোহাম্মদী’ সৃষ্টি করেছেন। আর ‘নূরে মোহাম্মদী’ হতে সমস্ত সৃষ্টিরাজি সৃজিত হয়েছে।এজন্যই হাদীস শরীফেহযরত রাসুল (সা.) ফরমান-
“আল্লাহ্ তায়ালা সর্বপ্রথম আমার ‘নূর’-কে সৃজন করেছেন। আমি আল্লাহ্র নূর হতে আর সমস্ত সৃষ্টিরাজি আমার নূর হতে।”(সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা-৩) এ প্রসঙ্গে হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ্ তায়ালাআরো বলেন, “আমি আমার চেহারা মোবারকের নূর দ্বারা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সৃষ্টি করেছি।” (সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা-৩)
অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-হযরত রাসুল (সা.)-এর মাধ্যমে আপন জাত-সত্তার পরিচয় প্রকাশ করবেন বলেই আল্লাহ্ তায়ালা স্বীয় গুণের পরিচায়করূপে তাঁকে সৃষ্টি করেছেন। হাদীসে কুদসীতে এরশাদ হয়েছে-“(হে হাবীব) আমি আপনাকে সৃষ্টি না করলে কোনো কিছুই সৃষ্টি করতাম না।”(সিররুল আসরার,পৃষ্ঠা-৭০)
আল্লাহ্ তায়ালা হযরত রাসুল (সা.)-কে মানবমন্ডলীর স্বাক্ষীদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করবেন বলেই সৃষ্টির আদিতে হযরত আদম (আ.) হতে শুরু করে পৃথিবীতে আগত সমস্ত নবী-রাসুলকে একত্রিত করে তাঁকে স্বীকার ও সাহায্য করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে-
“স্মরণ করো! যখন আল্লাহ্ নবীদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দিয়েছি, অতঃপর তোমাদের কাছে যা আছে, তার সমর্থকরূপে যখন একজন রাসুল [হযরত মুহাম্মদ (সা.)] আসবেন, তখন তোমরা অবশ্যই তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। তিনি (আল্লাহ্) বললেন- ‘তোমরা কি স্বীকার করলে? এবং এ সম্পর্কে আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে?’ তারা বলল, ‘আমরা স্বীকার করলাম।’ তিনি বললেন, ‘তবে তোমরা স্বাক্ষী থাকো এবং আমিও তোমাদের সাথে স্বাক্ষী রইলাম’।” (সূরা আলে ইমরান-৩ : আয়াত-৮১)
হযরত রাসুল (সা.) সমস্ত নবীগণের সর্দার ও সমস্ত সৃষ্টির সেরা বলেই তাঁকে ইমামুল মুরসালীন বা পয়গাম্বরগণের ইমাম বলা হয়েছে এবং পৃথিবীতে তাঁর আগমনের সুসংবাদ পূর্ববর্তী নবী-রাসুলগণের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে প্রথম আসমানী কিতাব তাওরাত-এ বর্ণিত হয়েছে- “তোমাদের প্রভু ঈশ্বর তোমাদের ভ্রাতৃদের মধ্য হতে আমার (মুসা) মতোই একজন পয়গাম্বর উত্থিত করবেন, তাঁর কথা তোমরা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করবে।”
ইঞ্জিল (বাইবেল)-এ বর্ণিত হয়েছে-“যদি তোমরা আমাকে ভালোবাসো, তবে আমার উপদেশ মতো কার্য করো; আমি স্বর্গীয় পিতার কাছে প্রার্থনা করব, যাতে তিনি তোমাদেরকে আর একজন শান্তিদাতা প্রেরণ করেন, যিনি চিরদিন তোমাদের সঙ্গে থাকতে পারবেন।” আরো বর্ণিত হয়েছে, “যা-ই হোক, আমার উচিৎ যে, তোমাদের মঙ্গলের জন্য আমি চলে যাই, কারণ আমি না গেলে সেই শান্তিদাতা আসবেন না; কিন্তু আমি যদি যাই তবে তাঁকে পাঠিয়ে দেবো।”
‘ভবিষ্য পুরাণ’-এ বর্ণিত হয়েছে, “ঠিক সেই সময় ‘মুহাম্মদ’ নামক এক ব্যক্তি যাঁর বাস ‘মরুস্থলে’ (আরব দেশে) আপন সাঙ্গপাঙ্গ-সহ আবির্ভূত হবেন। হে আরবের প্রভু! হে জগৎগুরু! তোমার প্রতি আমার স্তুতিবাদ। তুমি জগতের সমুদয় কলুষ নাশ করার উপায় জানো, তোমাকে নমস্কার। হে পবিত্র পুরুষ! আমি তোমার দাস। আমাকে তোমার চরণতলে স্থান দাও!”
‘উপনিষদ’-এ আছে, “আল্লাহ্ সকল গুণের অধিকারী। তিনি পূর্ণ ও সর্বজ্ঞানী। মুহাম্মদ আল্লাহ্র রাসুল। আল্লাহ্ আলোকময়, অমিয়, এক চিরপরিপূর্ণ এবং স্বয়ম্।”
বস্তুতঃ হযরত রাসুল (সা.)-এর মাহাত্ম্য ও সম্মানে সমগ্র সৃষ্টিজগৎ তাঁর প্রশংসায় উদ্বেলিত হয়ে উঠে। তাঁকে প্রকৃত পরিচয়ে পরিপূর্ণ বৈশিষ্ট্যে বক্ষে লালনের জন্য বিশ্বপ্রকৃতি যুগ-যুগ ধরে অধীর আগ্রহে প্রহর গুণছিল।
হযরত রাসুল (সা.)-কে তাঁর আপন রূপে কোলে পাওয়ার জন্য যুগ-যুগান্তরের প্রতীক্ষায় পুঞ্জীভূত বেদনা ও ক্লান্তিতে সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতি উতলা হয়ে উঠে। পৃথিবীজুড়ে মানুষের নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় যাবতীয় বিষয়ে নেমে আসে চরম অধঃপতন। মানুষকে পাপ কালিমা থেকে উদ্ধার করার মতো মহীরূহের অভাবে তখন মানুষ জীবাত্মার বশীভূত হয়ে মানবীয় গুণাবলি হারিয়ে আনাচার, অবিচার, ব্যভিচার ছাড়াও অগ্নিপূজা, মূর্তিপূজার ন্যায় বিভিন্ন খোদাদ্রোহী কার্যে লিপ্ত ছিল। পাপ-পঙ্কিলতার অন্ধকার থেকে পরিত্রাণ পেয়ে আলোর দিশা পাওয়ার জন্য পৃথিবীর আকাশ-বাতাস, জল-স্থল, পাহাড়-পর্বত সমস্তই ঐকান্তিকভাবে ‘নূরে মোহাম্মদী’-এর আগমনের প্রত্যাশায় ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল।
পৃথিবীর এমনি ঘনঘোর তমসাচ্ছন্ন দিনে মানব জাতিকে সত্য ও শান্তির পথে তুলে আনার জন্যে মহান আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর সর্বোত্তম সৃষ্টি হযরত রাসুল পাক (সা.)-কে হিজরীপূর্ব ৫৩ সালের ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার সুবেহ সাদিকের সময় এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। যাঁকে প্রেরণের মাধ্যমে রাব্বুল ইজ্জত আপন মহিমাকে প্রকাশিত করতে চেয়েছিলেন, সেই রাহমাতুল্লিল আলামিনহযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিন আল্লাহ্র কাছে সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল। তাই হযরত রাসুল (সা.)-কে পৃথিবীতে প্রেরণের আনন্দের আতিশয্যে মহান আল্লাহ্ তায়ালা স্বীয় ফেরেশতাদের নিয়ে তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করছিলেন এবং মানুষকেও তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করে শ্রদ্ধার সাথে সালাম জানাতে নির্দেশ করেছেন। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে-
“নিশ্চয়ই আল্লাহ্ নিজে ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর উপর দরূদ পাঠ করেন। হে বিশ্বাসীরা! তোমরাও তাঁর উপর দরূদ পাঠ করো ও শ্রদ্ধার সাথে সালাম পেশকরো।”(সূরা আল আহযাব-৩৩ : আয়াত-৫৬)
সূফী সাধকগণের মতে,যে দিন হযরত রাসুল পাক (সা.) ধরাধামে আগমন করেছিলেন, সেদিন আল্লাহ্ নিজে,তাঁর ফেরেশতা,সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম,সমস্ত আওলিয়ায়ে কেরাম রূহানীতে হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভজন্মের আনন্দ প্রকাশ করেন এবং তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে বলেছেন,“আস্সালাতু আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ্! আস্সালাতু আস্সালামুআলাইকা ইয়া হাবীবাল্লাহ! মারহাবা ইয়া রাসুলাল্লাহ! মারহাবা ইয়া হাবীবাল্লাহ্!”
হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভজন্মের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘মাওয়াহিবু লাদুন্নিয়া’ কিতাবে বলা হয়েছে- হযরত আমিনা (আ.) বলেন, “প্রশংসিত সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় আমি তাঁকে সেজদা অবস্থায় দেখেছিলাম।উভয় হাতের তর্জনী আঙ্গুলি দোয়া ক্রন্দনকারীর ন্যায় আকাশের দিকে প্রসারিত ছিল।” মা আমিনা (আ.) আরো বলেছেন,“সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর কারা যেন তাঁর সন্তানটিকে নিয়ে গিয়ে সমস্ত সৃষ্টিজগৎ পরিভ্রমণ করান। তিনি তাদের কথাবার্তা শুনেছিলেন।তিনি ঊর্ধ্বলোকের সম্মানিত ব্যক্তিগণের কথাবার্তার এক অংশে শুনেছিলেন যে, মুহাম্মদকে সকল নবীর গুণাবলিতে বিভূষিত করো এবং সকল আম্বিয়াগণের চরিত্রসাগরে ডুবিয়ে দাও।”
হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মলগ্ন বহু অলৌকিক ঘটনায় পরিপূর্ণ।যেমন- (১) নওশেরাওয়া বাদশাহ্র সিংহাসন নড়ে ওঠা; (২) সাওয়া হ্রদ শুকিয়ে যাওয়া; (৩) সামওয়াউপত্যকা পানিতে প্লাবিতহওয়া; (৪) পারস্যের অগ্নিকুণ্ড হঠাৎ নিভে যাওয়া; (৫) কাবাঘরের ‘হুবল’ নামক বৃহৎ মূর্তিটির উপুড় হয়ে পড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
‘নূরে মোহাম্মদী’ নামক কিতাবে আছে, “ঐ রাতে কোরায়েশদের একটি মূর্তির মুখ দিয়ে কথা বের হয়েছিল। সে বলেছিল, একটি পবিত্র সন্তান প্রকাশ হওয়ায় চাদর পরিধান করেছি। এর জ্যোতিতে পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিমের সমস্ত এলাকা আলোকিত হয়ে গিয়েছে। তাঁরই উদ্দেশে সকল মূর্তি উপুড় হয়ে পড়েছে। আর তাঁর ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে বিশ্বের সমস্ত রাজা-বাদশাহ্দের প্রাণ কেঁপে উঠেছে।”
প্রিয় পাঠক! এখন চিন্তা করে দেখার বিষয় যে, কেন আল্লাহ্ তায়ালার কাছে হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিনটি এত দীর্ঘ কাক্সিক্ষত ছিল? আর কেনইবা তিনি তাঁর শুভ জন্মদিনে এত বেশি আনন্দিত হয়ে জগতে অফুরন্ত রহমত-বরকত নাজিল করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহ্র সাথে হযরত রাসুল (সা.)-এর কি নিবীড় সম্পর্ক বিদ্যমান, তা এর থেকে আঁচ করা যায়।
মহান আল্লাহ্ তায়ালা হযরত রাসুল (সা.)-এর নূর হতে সমগ্র সৃষ্টিরাজি সৃজন করে তাঁকে একেবারে আপন করে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেছেন। এজন্যই আল্লাহ্ তায়ালা নিজের সম্বন্ধে এরশাদ করেন,“রাব্বুল আলামীন”-“মহাবিশ্বের প্রভু”; আর হযরত রাসুল (সা.) সম্বন্ধে এরশাদ করেন,“রাহমাতাল্লিল আলামিন”-“মহাবিশ্বের রহমত”।অর্থাৎ আল্লাহ্ তায়ালা যতটুকু জগতের প্রভু,হযরত রাসুল (সা.)-ও ততটুকু জগতের জন্য রহমত। আবার আল্লাহ্ তায়ালা নিজের সম্বন্ধে এরশাদ করেন-
“আল্লাহ্ নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের নূর বা জ্যোতি” (সূরা আন নুর-২৪ : আয়াত-৩৫)। পক্ষান্তরে, হযরত রাসুল (সা.) সম্বন্ধে এরশাদ করেন-“প্রজ্বলিত বাতি”। অর্থাৎ- আল্লাহ্ হলেন আলো বা জ্যোতি; আর হযরত রাসুল (সা.) হলেন প্রদীপ। অধিকন্তু মহান আল্লাহ্ যে, হযরত রাসুল (সা.)-এর মাঝে বিরাজমান সে কথা বুঝাতে গিয়ে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে- “(হে হাবীব!) আপনি বলেদিন, যদি তোমরা আল্লাহ্কে ভালোবাসো, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, তবে আল্লাহ্ও তোমাদের ভালোবাসবেন, তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন।” (সূরা আলে ইমরান-৩ : আয়াত-৩১)।
হযরত রাসুল (সা.)-এর কাছে আত্মসমর্পণ করলেই যে, আল্লাহ্তে আত্মসমর্পণ করা হয়, এ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে- “যারা আপনার কাছে আনুগত্যের শপথ করে, তারা তো আল্লাহ্র কাছে আনুগত্যের শপথ করে। আল্লাহ্র হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে।” (সূরা আল ফাতহ-৪৮ : আয়াত-১০)
এমনিভাবে আল্লাহ্ তায়ালা বারবার সতর্ক করেছেন, যেন কেউ হযরত রাসুল (সা.)-কে আল্লাহ্ হতে বিচ্ছিন্ন মনে না করে। তারপরও যদি কেউ তা করে, তবে এর ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করে এরশাদ হয়েছে- “যারা আল্লাহ্ ও রাসুলগণের সাথে কুফুরী করে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলগণের মধ্যে পার্থক্য করে এবং বলে আমরা কতককে বিশ্বাস করি আর কতককে অবিশ্বাস করি এবং তারা মধ্যবর্তী কোনো পথ অবলম্বন করতে চায়, প্রকৃতপক্ষে তারাই কাফের এবং কাফেরদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।” (সূরা আন নিসা-৪ : আয়াত-১৫০ ও ১৫১)
আর যারা আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর মধ্যে পার্থক্য করে না, তাদের পুরস্কারের প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে- “যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলগণের প্রতি বিশ্বাস আনে এবং তাঁদের একের সাথে অপরের পার্থক্য করে না; তাদেরকে তিনি পুরস্কৃত করবেন।” (সূরা আন নিসা-৪ : আয়াত-১৫২)।
মহান আল্লাহ্ তায়ালা বারবার বুঝাতে চেয়েছেন যে, হযরত রাসুল (সা.) হলেন সৃষ্টির মূল উপাদান। সৃষ্টিকূলের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই যেহেতু হযরত রাসুল (সা.)-এর আবির্ভাব, সেহেতু তাঁর শুভজন্মের দিন তথা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর দিনটি আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের জন্যও সবচেয়ে আনন্দময় দিন। তাই তিনি সবাইকে আনন্দ প্রকাশের নির্দেশ দিয়ে এরশাদ করেন- “(হে হাবীব) আপনি বলুন! আল্লাহ্র এ অনুগ্রহ [রাসুল (সা.)-এর প্রেরণ] ও তাঁর দয়ার প্রতি আনন্দ প্রকাশ করা উচিৎ তা তাদের সমস্ত ধন-দৌলত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।” (সূরা ইউনুস-১০ : আয়াত-৫৮)
কিন্তু পরিতাপের বিষয় আমরা হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিন তথা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপন করি না। অথচ হেদায়েতের আলোকবর্তিকা নিয়ে যত নবী-রাসুল এ পৃথিবীতে এসেছেন, হযরত রাসুল (সা.) হলেন তাঁদের সবার নেতা। তাঁর সুপারিশ ব্যতীত কারো মুক্তি হবে না। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে-
“সেদিন (শেষ বিচারের দিন) আমি প্রত্যেক সম্প্রদায় হতে তাদেরই একজন (নবী) সাক্ষী হিসেবে উত্থিত করবো এবং আপনাকে [রাসুল (সা.)] আমি তাদের সত্যায়নকারী হিসেবে আনয়ন করব।” (সূরা আন নাহল-১৬ : আয়াত-৮৯)
সামাজিকভাবে দেখা যায়, খ্রিষ্টানরা তাদের নবী হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মদিন মহাধুমধামের সাথে পালন করে থাকে। অনুরূপভাবে অন্য সকল ধর্মাবলম্বীরাও নিজ নিজ ধর্মের প্রবর্তকগণের জন্মদিন সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে পালন করে থাকে। কিন্তু আমাদের নবী হযরত রাসুল (সা.) সমস্ত নবী-রাসুলগণের ইমাম বা নেতা হওয়া সত্ত্বেও আমরা তাঁর শুভ জন্মদিন পালন করি না। অথচ পৃথিবীর সমস্ত নবী-রাসুল ও ধর্মপ্রচারকই হযরত রাসুল (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে তাঁর আশীর্বাদ কামনা করেছেন।যেমন- হযরত ঈসা (আ.) বলেন, “হে বনীইসরাইল! আমি তোমাদের কাছেআল্লাহ্ররাসুল।আমার পূর্ববর্তী তাওরাতের আমি প্রত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসুলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন, তার নাম- ‘আহমদ’।” এমনকি হযরত ঈসা (আ.) হযরত রাসুল (সা.)-এর উম্মত হওয়ার আকাক্সক্ষাও করেছিলেন।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুলের উম্মত হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে চিনতে পারলাম না। আমাদের মাঝে কেউ কেউ মনে করেন, হযরত রাসুল (সা.) দুনিয়া থেকে পর্দা করার পর মাটির সাথে মিশে গেছেন। আমাদের জন্য তাঁর আর কিছু করার নাই। অথচ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন-“হে রাসুল! আমি আপনাকে স্বাক্ষীদাতা,সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।”(সূরা আল আহযাব-৩৩ : আয়াত-৪৫)
যেহেতু তিনি সমগ্র মাখলুকাতের সাক্ষীদাতা, সেহেতু তিনি সর্বকালেই ছিলেন,আছেন এবং থাকবেন। অন্যথায় তিনি না দেখে সাক্ষী দেবেন কীভাবে?আসলে আমরা হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বত হারিয়ে ফেলেছি। অথচ হযরত রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসার প্রতি গুরুত্বারোপ করে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছেÑ“যে ব্যক্তি নিজের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি ও অন্যসকল মানুষ অপেক্ষা আমাকে বেশি ভালো না বাসবে, সে মু‘মিন হতে পারবে না।” (বোখারী ও মুসলিম শরীফ)আমরা প্রকৃত ঈমানদার হতে পারিনি বলেই হযরত রাসুল (সা.)-এর পূর্ণাঙ্গ মহব্বত আমাদের মাঝে নেই।আমরা হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে নিজের ছেলে-মেয়ের জন্মদিন ধুমধামের সাথে পালন করি।অথচ হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিনপালনের প্রয়োজনীয়তা আমরা অনুভব করি না।
হাদীস শরীফে বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু দারদা (রা.) বর্ণনা করেন যে, তিনি একদিন রাসুল (সা.)-এর সাথে আবু আমের আনসারী (রা.)-এর বাড়িতে গিয়ে দেখতে পেলেন, আবু আমের (রা.)তাঁর ছেলে-মেয়ে ও আত্মীয়-স্বজনকে একত্রিত করে হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিনের বিবরণ শোনাচ্ছেন। তাঁর এ কাজে হযরত রাসুল (সা.) অত্যন্ত আনন্দ বোধ করলেন এবং বললেন, “হে আমের! নিশ্চয় আল্লাহ্ তায়ালা তোমার জন্যে তাঁর রহমতের দরজা খুলে দিয়েছেন এবং ফেরেশতারা তোমার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।যারা তোমার ন্যায় এমন কাজ করবে তারাও তোমার মত ফজিলত পাবে।
অন্য বর্ণনায় জানা যায়,একদিন হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.)তাঁর ঘরে মিলাদের আয়োজন করে পাড়া-প্রতিবেশীদের একত্রিত করে হযরত রাসুলূল্লাহ্ (সা.)-এর জন্মদিনের বর্ণনা করছিলেন,যা শুনে উপস্থিত সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর উপর দরূদ ও সালাম পাঠ করছিলেন।এমন সময় হযরত রাসুল (সা.) সেখানে উপস্থিত হলেন এবং খুশি হয়ে তাঁদের উদ্দেশ্যে বললেন-“তোমাদের শাফায়াত করা আমার জন্য ওয়াজিব হয়ে গেছে।”
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.)তাঁর বিখ্যাত ফতহুল বারী কিতাবে বর্ণনা করেন-“হযরত সুহাইলি (রা.) কর্তৃক হযরত আব্বাস (রা.) থেকে এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,‘আবুলাহাবের মৃত্যুর এক বছর পর তাকে স্বপ্নে দেখি যে, সে অত্যন্ত আযাবের মধ্যে আছে। তার অবস্থাসম্পর্কে আবু লাহাব জানায়, ‘তোমাদের ছেড়ে আসার পর থেকে আমি শান্তির মুখ দেখিনি, তবে প্রতি সোমবারআমার আযাব লাঘব করা হয়।’ হযরত আব্বাস (রা.) বলেন,“তার এ আযাব লাঘবের কারণ হলো- হযরতরাসুল (সা.)-এর জন্মদিন ছিল সোমবার। তাঁর শুভ জন্মের সুসংবাদ নিয়ে আসায় দাসীসুয়াইবাকেসে খুশি হয়েমুক্তি দিয়েছিল।” (ফতহুল বারী, ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১১৮)
একজন কাফের হয়েও হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মের সংবাদে খুশি হওয়ায় যদি আবু লাহাব উপকৃত হতেপারে, তাহলে হযরত রাসুল (সা.)-এর উম্মত হয়ে তাঁরশুভ জন্মদিন আনন্দের সাথে উদ্যাপন করে আমরা নিঃসন্দেহে আরো অধিক উপকৃত হব।আমরা যদি এ যুগে তাঁর শুভ জন্মদিন মহাধুমধামের সাথে পালন করি, তাহলে দয়াল রাসুল (সা.) আমাদের উপর খুশি হবেন।আমাদের মুক্তির রাস্তা খুলে যাবে।পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) সম্বন্ধে ইমাম আল্লামা শেহাবুদ্দীন আহম্মদ বিন হাযার আল্-হায়তামী আল্-শাফী (রহ.) প্রণীত“আন্-নেয়ামাতুল কুবরা আলাল আলম ফি মওলুদে সাইয়্যেদিল আনাম” নামক কিতাবের ৭ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছেÑ
১। ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলেন-যে ব্যক্তি হুজুর (সা.)-এর মিলাদ শরীফে অর্থ ব্যয় করবে,সে আমার সাথে বেহেশতে থাকবে।
২। হযরত ওমর (রা.) বলেন-যে ব্যক্তি হুজুর (সা.)-এর মিলাদ শরীফকে ইজ্জত ও সম্মান দেবে, সে যেন ইসলামকে পুনর্জীবিত করল।
৩। হযরত ওসমান (রা.) বলেন-প্রিয় নবী (সা.)-এর মিলাদ শরীফ উদ্যাপন করতে গিয়ে অর্থ ব্যয় করবে, সে যেন বদর ও হুনাইনের মতো মহান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল।
৪। হযরত আলী মুরতাজা (রা.) বলেন-ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপনকারী ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করবে।
অথচ ধর্মীয় বিষয়ে আমরা এত বেশি উদাসীন যে,যিনি আমাদের রাসুল,যাঁর শাফায়াত ব্যতীত কারো মুক্তি হবে না,যাঁর উপর দরূদ না পড়লে কারো প্রার্থনা আল্লাহ্র দরবারে মঞ্জুর হয় না,আর সেইরাসুল(সা.)-এর পৃথিবীতে জন্মগ্রহণের এ পূণ্যময় দিনটি আমরা পালন করি না।আমরা হযরত রাসুল (সা.)-এরনির্দেশানুযায়ী রমজানের রোজা শেষে ঈদুল ফিতর এবং হজের পরদিন ঈদুল আযহা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালন করে থাকি।অথচ যিনি আমাদের এ দুই ঈদ এনে দিলেন, তাঁর শুভ জন্মদিন যে এ দুই ঈদের চেয়েও বেশি আনন্দের তা আমরা বুঝি না।আমরা আমাদের সমাজ জীবনের দিকে তাকালে দেখতে পাই, একটি খুশির সংবাদের জন্য আমরা কতই না প্রতীক্ষা করি!সন্তানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে পিতা-মাতা মিষ্টি কিনে ছেলে-মেয়ে,পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়।দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কারো ঘরে যদি সন্তান আসে, তার তো খুশির সীমাই থাকে না!দেখা যায়,সবাইকে দাওয়াত দিয়ে সাধ্যমতো আপ্যায়ন করা সত্ত্বেও তৃপ্তি মিটে না।প্রতি বছর ঐ সন্তানের জন্মদিন ধুমধাম ও আনন্দের সাথে উদ্যাপন করে বহুদিনের কামনার ধন এ সন্তানকে পাবারক্ষণটিকে স্মরণ করা হয়।আসলে একটি পরম কাক্সিক্ষত জিনিস লাভ করার পর আনন্দে আত্মহারা হওয়াই তো স্বাভাবিক।যাঁর নূরে সমগ্র মাখলুকাত পয়দা,যাঁকে সৃষ্টি না করা হলে জগৎকে সৃষ্টি করা হতো না,সে রাহমাতুল্লিল আলামীনের জন্মদিন কি আমাদের জন্য আনন্দময় হতে পারে না?যে মহামানবকে জগতের বুকে পাবার জন্য সমগ্র মাখলুকাত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তাঁর উপর দরূদ ও সালাম পাঠ করে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে,যাঁর আগমনের উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে গিয়ে মহান প্রভু হাজার হাজার অবাধ্য জনপদকে ধ্বংস করতেও কুণ্ঠিত হননি,আল্লাহ্রসবচেয়ে প্রিয় সেই বন্ধুর জন্মদিন কি আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি আনন্দের হওয়া উচিত ছিল না?
তাই মহাপবিত্র দিন,ঈদে মিলাদুন্নবী(সা.) উপলক্ষ্যে আমাদের প্রার্থনা হওয়া উচিত-আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের সবাইকেতাঁর সবচেয়ে প্রিয় হাবীবের শুভ জন্মদিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করে যথাযোগ্য মর্যাদায় তা পালনের মাধ্যমে এর পূর্ণ ফায়েজ, বরকত ও রহমত লাভের তাওফিক দান করুন। আমীন।