আজ শুক্রবার, অক্টোবর ১৭, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বাংলাদেশ ১৯৮৯ সাল থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে আসছে। এই সময়ে একটি অন্যতম বৃহৎ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমঞ্চে পরিচিতি লাভ করেছে বাংলাদেশ। এই অংশগ্রহণ শুধু আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও মানবিক সহমর্মিতার প্রতিফলন নয়, বরং শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত সদস্যরা যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন, তা বাংলাদেশের রেমিট্যান্সপ্রবাহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

এছাড়া আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় সক্রিয় অংশগ্রহণ বাংলাদেশকে একটি শান্তিপ্রিয়, মানবিক ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে।

তবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের একমাত্র অবশিষ্ট কনটিনজেন্টকে কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্তে বৈশ্বিক শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের পুলিশের দীর্ঘদিনের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ অংশগ্রহণ নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশের জন্য ‘গুরুতর আঘাত’ বা ‘বড় ধাক্কা’ হিসেবে দেখছেন। শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তার চোখে উদ্ভূত পরিস্থিতি বাংলাদেশ সরকারের স্পষ্ট ‘কূটনৈতিক দুর্বলতা’।

 

১৮০ সদস্যের এই কনটিনজেন্টের মধ্যে ৭০ জন নারী পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন। তারা আগামী নভেম্বরের মধ্যে দেশে ফিরে আসবেন বলে জানা গেছে। মাত্র দুই মাস আগে এই কনটিনজেন্টের অংশ হিসেবে জাতিসংঘের একমাত্র সবচেয়ে বড় নারী পুলিশ ইউনিট মোতায়েন করা হয়েছিল।

জাগো নিউজের কাছে আসা জাতিসংঘের নথিতে কঙ্গো, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র এবং দক্ষিণ সুদানের বিভিন্ন মিশনে ধাপে ধাপে সদস্য সংখ্যা কমানো ও প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনা উল্লেখ করা রয়েছে।

ওই নথি অনুযায়ী, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যাদের পুরো কনটিনজেন্ট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ক্যামেরুন, সেনেগাল ও মিশরের মতো দেশের কনটিনজেন্ট আংশিকভাবে হ্রাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ পুলিশ সূত্র জানায়, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনগুলোতে চলমান অর্থ সংকটের কারণেই এই সদস্যসংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

 

সূত্র বলছে, কঙ্গোতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে ২০ অক্টোবরের মধ্যে ১৬২ জন সদস্যকে প্রত্যাবাসন করা হবে, আর বাকি ১৮ জন প্রশাসনিক ও লজিস্টিক কার্যক্রম সম্পন্ন করে নভেম্বরের মধ্যভাগে ফিরবেন।

বর্তমান এ দলটি আগস্টে কঙ্গো পৌঁছে ১০ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যক্রম শুরু করে। মাত্র এক মাস পরই জাতিসংঘ তাদের ফেরার নির্দেশ দিয়েছে।

কনটিনজেন্টের নেতৃত্বে রয়েছেন পুলিশ সুপার জান্নাত আফরোজ। তিনি তার ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে লিখেছেন, জীবনের যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে চুপ থেকে আল্লাহর সিদ্ধান্তকে মেনে নেওয়ার শিক্ষা আমি আমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। আমি সবসময় বিলিভ করি, আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। বাংলাদেশ পুলিশের জাতিসংঘ মিশনের লাস্ট রোটেশন আমরা। খুব অল্প সময়েই শেষ হয়ে গেলো এই রোটেশন।

‘আমরা ১৮০ জনই আসছিলাম রোটেশন পুরোটা শেষ করার স্বপ্ন নিয়ে। প্রস্তুতিও ওইরকমই ছিল। বাট, সবার উপরে আল্লাহর ইচ্ছা… আল্লাহর প্ল্যান। আজ সন্ধ্যা ৬টায় বাংলাদেশ টাইম রাত ১১টায় (১৪ অক্টোবর) আমাদের অপারেশনাল অ্যাক্টিভিটি শেষ।’

তিনি আরও লিখেছেন, এই দেড় মাস আমার কনটিনজেন্টের সবাই জান-প্রাণ দিয়ে ডিউটি করেছে। কারণ, জাতিসংঘের ব্যয় সংকোচন নীতি সম্পর্কে আমরা আগেই জেনেছিলাম। জানতাম যে, মিশন শেষ হয়ে যাবে তাই সবাই চেষ্টা করছিল যেন ডিউটিতে কোনো ভুল না ধরতে পারে। বাট, এত তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত আসবে আমরা কেউ বুঝতে পারি নাই।

 

‘এটি আমার টোটাল কনটিনজেন্টের জন্য বেশ কষ্টের। ছয় মাস ট্রেনিং করে দেড় মাসের মাথায় ব্যাক করাটা কষ্টের আসলেই। তবে ওদের সঙ্গে আমি রেগুলার রোল কলে যাচ্ছি। ওরা প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠেছে। আমি তো টিম লিডার। আমাকে নিজের কষ্ট চাপা দিয়েই বাকিদের ওয়েলফেয়ার ভাবতে হবে।’

পুলিশ সুপার জান্নাত আফরোজ আরও লেখেন, কাল থেকে ক্যাম্প বুঝিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু হবে। ১৭ বছরের যত মালামাল আর সেবা আছে সব কার্গোতে বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হবে। সবাই একসঙ্গে কাজ করবো আমরা। একসঙ্গে এসেছিলাম…একসঙ্গেই চলে যাবো। আমার ধারণা, এখন মন খারাপ হলেও এরা যখন দেশে গিয়ে নিজের বাচ্চা বা জামাই বা মা-বাবার মুখ দেখবে তখনই এদের মন ভালো হয়ে যাবে।

অন্তত পাঁচজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অবদানের জন্য বড় ‘ধাক্কা’। একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এই ইউনিট দেশের জন্য সম্মান ও গৌরব বয়ে এনেছে। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে যদি এটি বন্ধ হয়ে যায়, তা হবে গুরুতর আঘাত।’

ঊর্ধ্বতন এক নারী পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারের সক্রিয় উদ্যোগের অভাবে আমাদের পুলিশ এখন পুরোপুরি কোণঠাসা, জাতিসংঘের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারছে না। অথচ নারী এফপিইউর ভূমিকা কেবল পুলিশের অর্জন নয়—এটি জাতীয় গৌরব, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরে। এটি ঠিক করতে হলে সরকারকে এখনই দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।’

পুলিশ সদরদপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, জাতিসংঘের বাজেট সংকোচন ও সংস্থার জনবল কমানোর নীতির কারণে বাংলাদেশের এফপিইউ ইউনিটকে নভেম্বরের মাঝামাঝি দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুরো কনটিনজেন্টকে যেন ফেরত না পাঠানো হয় সেজন্য কূটনৈতিকভাবে আলোচনা চলছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদরদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘কঙ্গোতে জাতিসংঘ মিশনের পুলিশ কমিশনার আমাদের ইউনিট কমান্ডারকে মৌখিকভাবে বিষয়টি জানিয়েছেন। এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি পাইনি। বাংলাদেশের এফপিইউ সবসময় ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করেছে, তাই এ সিদ্ধান্তটি বেশ হতাশাজনক।’

জানতে চাইলে পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বছর তিনেক আগে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করা পুলিশের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের কূটনৈতিক দুর্বলতাকেই প্রকাশ করছে।’

তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ সাধারণত সদস্যসংখ্যা কমালে তা সব দেশের ক্ষেত্রেই আংশিকভাবে প্রযোজ্য হয়। কিন্তু এবার পুরো বাংলাদেশ এফপিইউকে নভেম্বরের মধ্যে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটি পুলিশের জন্য যেমন হতাশার, তেমনই জাতির জন্যও। সরকারের উচিত ছিল জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনায় যাওয়া।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জাতিসংঘ সদরদপ্তরের স্থায়ী প্রতিনিধিকে বাংলাদেশের বিষয়ে ইতোমধ্যে অনুরোধ করা হয়েছে। তবে এখনো তারা কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। অন্য দেশগুলোতে সদস্য সংখ্যা কমানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সব সদস্যকে দেশে ফেরতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিষয়টি পুরোপুরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এখন। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কূটনীতি শুরু করেছে কি না, আগে খোঁজখবর নিয়েছে কি না দেখা দরকার।’

তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের ফান্ড কমে আসবে, এটি না জানার কারণ নেই। বিশেষত ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কূটনীতি শুরু হওয়া উচিত ছিল। এখনো সময় আছে কূটনৈতিকভাবে আলোচনা জোরদার করলে বাংলাদেশের জন্য ভালো খবর এলেও আসতে পারে।’

পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের পদযাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে, নামিবিয়া মিশনে। বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের ২১৫ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে এফপিইউ মিশনে ১৭৮ জন এবং ইন্ডিভিজুয়াল পুলিশ অফিসার (আইপিও) ৩৭ জন। বাংলাদেশ পুলিশের ৭৫ জন নারী পুলিশ সদস্য শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত রয়েছেন। তার মধ্যে এফপিইউ মিশনে ৬৮ জন এবং ইন্ডিভিজুয়াল পুলিশ অফিসার (আইপিও) পদে ৭ জন।

বাংলাদেশ পুলিশের ২১ হাজার ৮১৬ জন সদস্য শান্তিরক্ষা মিশনে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন শেষে দেশে ফিরেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ পুলিশের ২৪ জন অকুতোভয় সদস্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। জাতিসংঘের ম্যান্ডেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ পুলিশের অনন্য অবদান বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।

Exit mobile version