আজ
|| ৩রা মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ২০শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ || ৪ঠা জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি
ফ্যাসিস্ট আমলের ঠিকাদার সিন্ডিকেটের মূল হোতা মহারাজের রাজস্ব বোর্ড দর্শন
প্রকাশের তারিখঃ ৩০ এপ্রিল, ২০২৫
স্টাফ রিপোর্টার : একসময় দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা মহিউদ্দিন মহারাজের এখন টাকা ও জমিজমার হিসাব রাখার জন্য একাধিক হিসাবরক্ষক রয়েছে। নিজ পরিবারের প্রায় প্রতিটি সদস্য এখন জেলার শীর্ষ ধনীদের তালিকায়।এই টাকার জোরেই এমপি হয়েছিলেন। এলাকাবাসীর মতে, তিনি ও তাঁর ভাইয়েরা টাকা খরচ করেন ‘ছেঁড়া পাতার’ মতো, তবে এলাকার উন্নয়নের জন্য নয়, নিজেদের প্রভাব ও সম্পত্তি ক্রয়ে এবং আওয়ামী লীগের পদ টিকিয়ে রাখতে ব্যয় করেছেন।
মহিউদ্দিন মহারাজ পিরোজপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। পিরোজপুর জেলার কাউখালী, ভাণ্ডারিয়া ও নেছারাবাদ উপজেলা নিয়ে এই সংসদীয় আসন।ছাত্রদল থেকে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন মহিউদ্দীন মহারাজ। পরে তিনি জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। সেখান থেকেই সরাসরি রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তবে রাজনৈতিক জটিলতার কারণে একসময় জাতীয় পার্টি ছাড়তে হয়। এরপর তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছায়ায় আশ্রয় নেন।
আওয়ামী লীগে ‘সোনার নৌকা’ নিয়ে প্রবেশের পর মহারাজের আর পেছনে তাকাতে হয়নি।তাঁর অর্থ, প্রভাব ও প্রতিপত্তি রূপকথার গল্পের মতো। দলীয় রাজনীতি তাঁর কাছে ছিল ধরাশায়ী। আইন-আদালত তাঁর কাছে ঠুঁটো জগন্নাথ। স্থানীয় প্রশাসনের বড় কর্মকর্তারা তাঁর কাছে ছিলেন ছাপোষা। মহারাজ বন্দনা করতে পাড়া-মহল্লা এমনকি ঘরে ঘরে গড়ে তোলা হয় কমিটি। এসবের জন্য টাকা যেন বাতাসে উড়ত। ফলে মহারাজ পরিবার যা চাইত, সেটাই হতো পিরোজপুরে। যে কোনো ভোটে নিজে জিততেন, পছন্দের প্রার্থীদের জেতাতেন।আগের দিনের মহারাজদের মতোই টাকার ভান্ডার ছিল মহারাজের। শুধু টাকার জোরে একটি জেলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি মাত্র কয়েক বছরে বদলে ফেলেছেন মহারাজ। এ প্রসঙ্গে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা খান এনায়েত করিম বলেন, ‘মহারাজ পরিবার যেভাবে টাকা খরচ করেছে, তাতে মনে হতো, তারা নিজেরাই টাকা ছাপাত।’জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়ান। সাতবারের সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে পরাজিত করে পিরোজপুর-২ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।তবে রাজনীতির এই উত্থানের আড়ালে ছিল আরেকটি পরিচয়—ঠিকাদার। মহারাজ নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। জনপ্রতিনিধির পরিচয়ের আড়ালে সরকারি প্রকল্পের অর্থে বিশাল ঠিকাদারি সাম্রাজ্য তৈরি করেন।এলজিইডিকে তারা পরিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো ব্যবহার করেছেন। গত কয়েক বছরে খুলনার শেখ পরিবার ও সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম কে ম্যানেজ করে তাদের ঠিকাদারি বাণিজ্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত হয়েছিল বলে জানা গেছে। মিরাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইফতি এন্টারপ্রাইজের নামে আওয়ামী লীগের আমলে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হাতিয়ে নেওয়া হয়। বিভিন্ন সময়ে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীকে ম্যানেজ করে অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ এনে আত্মসাৎ করতেন। এতে সহায়তা করতেন পিরোজপুর ও ভাণ্ডারিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলীরা। পারিবারিক জমিতে জলবায়ু ট্রাস্টের প্রকল্পের অনুকূলে ইকোপার্কের নামে রিসোর্ট বানিয়ে দখল করেন মহিউদ্দিন মহারাজ এবং তাঁর ভাই মিরাজুল ও শামসুদ্দিন। সরকারি ভবন নিজেদের বসতবাড়ির মতো ব্যবহার করতেন।
এদিকে মিরাজুলের স্ত্রী শামীমা আক্তার হয়ে উঠেছিলেন প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার।এই পরিবারের ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ১২৮টি সেতু নির্মাণের জন্য প্রায় ২৩৬ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—মহারাজের মেসার্স হরিণপালা ট্রেডার্স, মিরাজুলের ইফতি ইটিসিএল (প্রা.) লিমিটেড ও সাউথ বাংলা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, শামীমার মেসার্স শিমু এন্টারপ্রাইজ, সামসুদ্দিনের তেলিখালী কনস্ট্রাকশন এবং সালাউদ্দিনের মেসার্স ঈশান এন্টারপ্রাইজ।
কিন্তু তদন্তে উঠে আসে ভিন্ন চিত্র। কাগজে-কলমে সেতুর অস্তিত্ব থাকলেও বাস্তবে একটি সেতুও নির্মিত হয়নি। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে এলজিইডির প্রকৌশলী ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় কোটি কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়। প্রকৌশলীদের স্বাক্ষর জাল করে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে এসব টাকা তোলা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ১৫ এপ্রিল এ ঘটনায় ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। এর মধ্যে পাঁচজন গ্রেপ্তার হলেও ১৮ জন এখনো পলাতক। মামলার বাদী, দুদকের পিরোজপুর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম জানান, দক্ষিণাঞ্চলের আয়রন সেতু প্রকল্পের আওতায় এসব অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।মহিউদ্দিন মহারাজের দেশে ও দেশের বাইরে কয়েক শ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে, তাঁর সম্পত্তি ও নগদ টাকা কয়েক হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে। টাকা দিতেন পদ বাগিয়ে নেওয়ার জন্য। দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর মার্কেট, আবাসিক ফ্ল্যাট, কৃষি ও অকৃষি জমি রয়েছে। ঢাকার অভিজাত এলাকায় তাঁর দোকান আছে, আছে মার্কেট। ভাণ্ডারিয়ার পাশের উপজেলা তুষখালিতে রয়েছে মার্কেট ও আবাসিক ভবন, তেলিখালি ইউনিয়নে রয়েছে মার্কেট, কারওয়ান বাজারে রয়েছে দোকান। স্থানীয়দের মতে, মহারাজ আন্তর্জাতিক স্বর্ণ ও চোরাচালান চক্রের সদস্য ছিলেন। নদীপথে ভারতীয় পণ্য পাচার ছিল তাঁর গোপন ব্যবসার অংশ।
তিনি তাঁর নির্বাচনী হলফনামায় ঠিকাদারি ব্যবসা থেকে তাঁর আয় ১৫ কোটি টাকা দেখিয়েছেন। বিভিন্ন ব্যাংকে একাধিক ডিপিএস, পিরোজপুর জেলা পরিষদে দোকান, ঢাকার মগবাজারে একাধিক ফ্ল্যাট, ঢাকার শ্যামপুরে জমি দেখিয়েছেন। স্বর্ণ দেখিয়েছেন ২০০ ভরি। ভাণ্ডারিয়ার বিভিন্ন মৌজায় সাড়ে ১০ একর কৃষিজমি দেখিয়েছেন। সব মিলিয়ে তাঁর জমি রয়েছে ৩৮০ একর বা এক হাজার ১৫০ বিঘা। ২০২৪ সালের নির্বাচনে কৃষি ও অকৃষি জমির তালিকা অনুযায়ী শীর্ষে ছিলেন এই মহিউদ্দিন মহারাজ। অথচ ভূমি আইন অনুযায়ী কারো ১০০ বিঘার ওপর জমি থাকার সুযোগ নেই।
এলাকাবাসী জানিয়েছে, এর বাইরেও তাঁর নামে-বেনামে হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। মালয়েশিয়া, দুবাই ও সিঙ্গাপুরেও টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। কাজ না করে বিভিন্ন প্রকল্পের মোট এক হাজার ৭৯ কোটি ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৮৩৯ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মহারাজের নামে মামলা করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত পৃথক ৮ মামলায় পিরোজপুর এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলীসহ ২৭ জনকে আসামি করা হয়েছে।পিরোজপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে এসব মামলা হয়েছে। মামলার পর গ্রেফতার এড়াতে দেশত্যাগ করেছেন মহিউদ্দিন মহারাজ।
এদিকে বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) মহিউদ্দিন মহারাজ ও তার স্ত্রী, সন্তান এবং মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে।
নির্দেশনায় বলা হয়, জব্দ করা ব্যক্তি ও তাদের স্ত্রী, পরিবারের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সব লেনদেন বন্ধ থাকবে।লেনদেন স্থগিত করার এ নির্দেশের ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা, ২০১৯-এর ২৬ (২) ধারা প্রযোজ্য হবে বলে বিএফআইইউর নির্দেশনায় বলা হয়েছে।
এদিকে, মহারাজ পরিবারের জব্দকৃত ব্যাংক হিসাব খুলতে পায়তারা করে যাচ্ছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গোয়েন্দা শাখার (সি.আই.সি) ও পলাতক সাবেক এমপি মহিউদ্দিন মহারাজের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত মো: ফরিদ সহ রাজস্ব বোর্ডের কিছু দুর্নীতিবাজ অসাধু কর্মকর্তারা। এ লক্ষ্যে তারা কাজ করে যাচ্ছেন বলে এনবিআর এর গোপন একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। এনবিআর সূত্রটি জানায়, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের এমপিদের আস্থাভাজন অনেকেই এখনও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তারা সাবেক এমপি মন্ত্রীদের জব্দকৃত ব্যাংক হিসাব খুলতে পায়তারা করে যাচ্ছেন। জব্দকৃত ব্যাংক হিসাবের টাকা দেশের বাইরে পাচারে সহায়তা করতে মহিউদ্দিন মহারাজের ব্যাংক হিসাব খুলে দিতেও চক্রটি কাজ করে যাচ্ছে। এবিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে জব্দকৃত ব্যাংক হিসাবের টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়ে যেতে পারে বলে জানায় এনবিআর এ সূত্র। শেষমেষ আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট আমলের ঠিকাদার সিন্ডিকেটের মূল হোতা মহিউদ্দিন মহারাজের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দর্শন সফল হয় কি না সেটিই এখন দেখার বিষয়।
সম্পাদক: মো: রবিউল হক। প্রকাশক: মো: আশ্রাফ উদ্দিন ।
প্রকাশক কর্তৃক বি এস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২, টয়েনবি সার্কুলার রোড (মামুন ম্যানশন, গ্রাউন্ড ফ্লোর), থানা-ওয়ারী, ঢাকা -১২০৩ থেকে মুদ্রিত
দেলোয়ার কমপ্লেক্স, ২৬ শহীদ নজরুল ইসলাম সড়ক (হাটখোলা), ওয়ারী, ঢাকা -১২০৩ থেকে প্রকাশিত ।
মোবাইল: ০১৭৯৮৬৫৫৫৫৫, ০১৭১২৪৬৮৬৫৪
ওয়েবসাইট : dailyjanadarpan.com , ই-পেপার : epaper.dailyjanadarpan.com
Copyright © 2025 Daily Janadarpan. All rights reserved.